আজ, সোমবার | ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১০:০৬

ব্রেকিং নিউজ :
উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মাগুরা সদরে রানা ও শ্রীপুরে রাজনের দিকেই সবার নজর মাগুরায় ঋষিপাড়ার সদস্যদের মধ্যে কৃষিব্যাংকের সহজশর্তে ঋণ বিতরণ মাগুরায় রানাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন ছাড়লেন ভিপি জাহাঙ্গীর শ্রীপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী রাজন-সংগ্রামের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ জমে উঠেছে শ্রীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন মাগুরায় জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপন বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ পড়ে কাঁদলেন শ্রীপুরের মুসল্লিরা মহম্মদপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় শিক্ষকের মৃত্যু মাগুরায় প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ মাগুরায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন জাহিদুর রেজা চন্দন ও নবীব আলী

সমাজকে বদলাতে হলে নিজকে আগে বদলাতে হবে

সুলতানা কাকলি : জীবন চলার পথে প্রতিটি পদক্ষেপে নিত্য নতুন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। হয়তো কোনটা আনন্দ দেয়, কোনটা বেদনাও বয়ে আনে। কোনোটার উত্তর পাই আবার কোনোটার উত্তর মনের গভীরে হাতড়ে খুঁজে পাইনা। যেগুলোর উত্তর মেলেনি সেগুলো মনের মাঝে দাগ কেটে বসে আছে। তার মধ্য থেকে বাছাই করে একটি গল্প শেয়ার করি।

আজকে আমার মনের মধ্যে সঞ্চিত জিজ্ঞাসা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। এই গল্পটা হয়তো কারো পছন্দ নাও হতে পারে। তবুও মনের আবেগে তাড়িত হয়ে লিখছি। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। বহু বছর আগে পরিচিত একজন দরিদ্র অসহায় মানুষ আমার দুয়ারে এসে দাঁড়ালো দুটি আশায়-একটি হলো অসুস্থতার জন্য কিছু সাহায্য আর অপরটি হলো ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করা। দাদাবাড়ী গ্রামে হবার সুবাদে লোকটি আমার পরিচিত ছিল,কেননা তার বাড়ী দাদাবাড়ির পাশের গ্রামে ছিলো। সে পেশায় গাছী। নারকেল গাছ বাছা, শীতের সময় খেঁজুর গাছ কাটা আর অন্য সময় আশে পাশের গ্রাম গুলোর মাঠে কৃষকের কাজ করতো। একদিন গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙে যায়। সুচিকিত্সা করতে না পেরে পা’ টা তারপঙ্গু হয়ে যায়। অভাব অনটনে না খেতে পেয়ে দুনিয়ার রোগ শোক তার ঘাড়ে এসে ভর করে।

যাহোক সে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের নিকট থেকে অতি কষ্টে একখান সীল মারা অসুস্থতার সার্টিফিকেট নিয়ে শহরে এসেছে সাহায্য চাইতে। সে জানতো না যে আমি তাকে চিনি। পরিশ্রমী সুঠাম দেহখানি জীর্নশীর্ণ কংকালসার। দেখে একটু ব্যথিত হলাম। ন্যুব্জে পড়া দেহতে কোন রকম জানটা ধুকপুক করছে। তাকে কিছু খাবার আর যা মনে চাইলো সামর্থ অনুযায়ী সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে বিদায় করলাম। তার খাবার সময়ে জানতে চাইলাম এবং বল্লাম, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে মাগুরায় এসেছ, তোমার যে অবস্থা, শহরের ব্যস্ত রাস্তায় তোমার তো কোন এক্সিডেন্ট হতে পারে? গ্রামের এত মানুষ থাকতে তুমি কেন এই শহরে এসেছ? লোকটি একথা শুনে বলল, মারে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায়না, এই কথাটা তুমি জানোনা?

দুঃস্থ, অসহায়, অশিক্ষিত মানুষের মুখে শিক্ষিতের মত কথা শুনে আমি ভীষণ বিস্মিত হলাম। এবং তার দিকে প্রশংসিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। তাকে বললাম, কেনো গ্রামের মানুষেরা কেউ তোমাকে সাহায্য করেনা? সে বল্লো, করেরে… মা কিন্ত নিত্যদিন আর কত সাহায্য করবে? কাজ কাম পারি না। গাছ থেকে পড়ে পা ভাঙছে, চলতে ফিরতে পারিনা। লাঠি নিয়ে যতটুকু পারি গ্রাম ঘোরার চেষ্টা করি।যা পাই তা দিয়ে চিকিত্সা করাবো, না পেটে দেবো, সবতো ওই পেটেই চলে যায়। এখন ঘুরলেও আর তেমন কিছু পাই না। তাইতো শহরে এসেছি কষ্ট করে যদি চিকিত্সার জন্য কিছু পাওয়া যায়।

প্রতিদিন কাজের সন্ধানে, সাহায্যের আশায় কত শত মানুষ শহরে ছুটছে, ভাগ্যের সন্ধানে, ভাগ্য বদলের আশায় তার খবর কেউ কি রাখে? শহর কি সবার ভাগ্য ফেরানোর শেষ ভরসা স্থল? শহরে প্রতিদিন মানুষের ঢল নামছে,শহর আর কত চাপ নেবে, ভেবে দিশা পাই না। অথচ গ্রাম কত সমৃদ্ধ ছিল। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, টাটকা শাক- সব্জি আর সুনির্মল বাতাস। বিভিন্ন মৌসুমে, পাল-পার্বনে গ্রাম হতো মুখরিত। আমরা যারা শহরে বাস করি তারা মুখিয়ে থাকতাম কবে ছুটি হবে কবে গ্রামে যাব আর নাড়ু, মুড়ি,মোয়া,মুড়কি, পুলি, পিঠা, ফিরনি, পায়েশ প্রাণ ভরে খাব। শীতের দিনে উঠোনে বসে রোদ পোহাবো আর খেঁজুরের রসে মুড়ি ভিজিয়ে আয়েশ করে খাব। সেই সাথে গ্রামের স্নিগ্ধ বাতাসে শরীরকে তরতাজা করে আবার শহরে ফিরে আসবো। গ্রামের বাড়ীতে যাবার জন্য আমরা সব সময় মুখিয়েই থাকতাম। সেই সমৃদ্ধ গ্রাম কালের বিবর্তনে কোথায় হারালো? লোকটিকে আবার আসতে বলে বিদায় জানালাম।

একটা বছর অতিক্রান্ত হলো, তাকে মনে মনে খুঁজি, কিন্ত সে আর এলো না। সেই সময় গ্রাম থেকে আমার এক আত্মীয় একদিন বেড়াতে এলে শুধালাম তার কথা। বলল, সেতো প্রায় একমাস হলো স্ট্রোক করে মারা গেছে। অনেকদিন বিছানায় পড়ে ছিল,আহা! বেচারা খুব কষ্ট পাচ্ছিলো, দেখার জন্য তার কেউ ছিলোনা। বউ আর ছোট ছোট দুই ছেলেকে অসহায় করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। এখন তাদের যে কি হবে? প্রসাঙ্গতরে আরোও জানতে পারলাম যে, তার মরার পর গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে কাফন দাফনের ব্যবস্থা করেছে আবার সাতদিন পর বিরাট আকারে মিলাদ মাহফিল ও সমাজে খাওয়া-দাওয়ার বেশ ভালই ব্যবস্থা করেছিলো আয়োজকরা ।অনেক মানুষের দাওয়াত করেছিল। শুনে যেমন ভাল লাগলো তেমনি এই ভেবে কষ্ট পেলাম যে, হায়রে মানুষ! জীবদ্দশায় টাকার অভাবে বিনা চিকিত্সায় মারা যায় আর মরার পরে চাঁদা তুলে সমাজে খাওয়া দাওয়াও হয়! ওই টাকাগুলো গ্রামবাসী তার জীবদ্দশায় যদি তার হাতে তুলে দিতো, হয়তো সে চিকিত্সা করার সুযোগ পেয়ে বেঁচে যেতে পারতো। এছাড়াও এটাও ভাবনায় এলো যে, গ্রামবাসী তার চেহলাম না করে চাঁদা তোলা ওই অর্থ গুলো যদি দুনিয়ায় রেখে যাওয়া তার বিধবা স্ত্রী ও এতিম সন্তানদের হাতে তুলে দিতো, তবে নিশ্চয়ই একটা সদগতি হতো।

সত্যি সেলুকাস! বিচিত্র এইদেশ! জীবিত অবস্থায় কদর নেই অথচ মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে কত আদিক্ষেতা। যুগের পর যুগ ধরে এই চলে আসছে। রাজনীতি, মিটিং, মিছিল, জ্বালাও, পোড়াও, টকশোতে বকবকানি, হেন- তেন কতকি? সমাজ বদলের গান শুনি, সমাজ তো বদলায় না, বদলায় কিছু মানুষের জীবন। তাতে নেই কোন নৈতিকতা। এভাবে আর কতদিন?
সেই কবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

তার কবিতায় নবীনদের এগিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে, নেতৃত্ব কাঁধে নিয়ে দিন বদলের কত আহবান করা হয়েছে, কিন্ত কারো কর্ণকূহরে তা প্রবেশ করেছে কি? দিন বদলের গান শুনি, দিন বদলও হয় না, সমাজেরও পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন হয় রাস্তা ঘাট, দালান কোঠা। আসলে আমাদের সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে যুবাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে। প্রাচীন ধ্যান ধারণার রীতি- নীতি পায়ে দলে যেখানে যুবারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেখানে অনেক আশার আলো প্রস্ফুটিত হচ্ছে। বদল চাইতে গেলে আগে আমাদের মন মানসিকতা বদলাতে হবে, নিজেরা না বদলালে সমাজের কোনদিন বদল হবে না।
সুলতানা কাকলি: লেখিকা, প্রাক্তন গার্লস গাইড

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology